Durnitibarta.com
ঢাকারবিবার , ৩ ডিসেম্বর ২০২৩
আজকের সর্বশেষ সবখবর

নির্বাচনে বিদেশি থাবা ও ডামি প্রার্থীর কৌশল

প্রতিবেদক
Khairul Islam Alamin
ডিসেম্বর ৩, ২০২৩ ৯:৩৭ অপরাহ্ণ
Link Copied!

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল তাঁর আচরণে যতটা সাবেক আমলা, তার চেয়ে বেশি নিজেকে রাজনীতিক হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।

আমাদের রাজনীতিকদের বেশির ভাগই গুছিয়ে কথা বলতে পারেন না। সিইসি গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। রাজনীতিকদের মতো তাঁর কথায়ও দ্ব্যর্থবাচকতা থাকে। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি নির্বাচন নিয়ে এত বেশি পরস্পরবিরোধী কথা বলেছেন, যা একত্র করলে আরেকটি ‘মহাভারত’ হয়ে যাবে।

তাঁর কথায় মনে হতো, কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন আর যা-ই হোক, ২০১৪ ও ২০১৮-এর মতো আরেকটি নির্বাচন করবে না। কিন্তু দিন শেষে এসে দেখা গেল ফলাফল শূন্য।

এখন পরিস্থিতি এতই নাজুক যে ক্ষমতাসীন দলকে বলতে হচ্ছে বিনা ভোটে জয়ী হওয়া যাবে না। বিকল্প বা ডামি প্রার্থী দিয়ে হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখাতে হবে। সে ক্ষেত্রে দলের আসনভিত্তিক কমিটি গঠন ও জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে কোনো ফারাক থাকে না। সাংবাদিক হিসেবে যাঁদের ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরা এত দিন ডামি বা নকল পোলিং এজেন্ট দেখেছেন। অনেক সময় প্রভাবশালী প্রার্থীর ভয়ে দুর্বল প্রার্থীরা পোলিং এজেন্ট দিতে সাহস পান না।

কিন্তু কেন্দ্রে তো নিয়ম অনুযায়ী সব প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট থাকতে হবে। তাই প্রভাবশালী প্রার্থী একাধিক ডামি পোলিং এজেন্ট নিয়োগ দিতেন। সাংবাদিকেরা জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা যেই প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট হয়েছেন, তার নামও বলতে পারেন না। এবারে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে আওয়ামী লীগকে ডামি প্রার্থী দিতে হচ্ছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার এত দিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে কথা বলেছেন। রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিক দলগুলোকে সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন। নির্বাচনের বিষয়ে তাদের ঐকমত্যে আসার কথা বলেছেন। এবারে বিদেশি থাবা আবিষ্কার করলেন।

সোমবার নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটির সদস্যদের প্রশিক্ষণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমাদের নির্বাচনে কিন্তু বাহির থেকেও থাবা, হাত এসে পড়েছে। তারা থাবা বিস্তার করে রেখেছে।’ দেশের অর্থনীতি, ভবিষ্যৎসহ অনেক কিছু রক্ষা করতে হলে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সেই সঙ্গে কাজী হাবিবুল আউয়াল দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে নির্বাচনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নির্বাচনের ফেয়ারনেসকে উপলক্ষ করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিভক্ত হয়ে গেছে, এটি কাঙ্ক্ষিত ছিল না।

নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া বিভিন্ন বিবৃতির প্রসঙ্গ নিয়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমাকে বাঁচাতে হলে, আমার জনগণকে বাঁচাতে হলে, আমার গার্মেন্টসকে বাঁচাতে হলে, আমার সাধারণ জনগণকে বাঁচাতে হলে, যে দাবিটা আমাদের জনগণের এবং পাশাপাশি বাইরের, ওরা খুব বেশি দাবি করেনি, ওদের একটাই দাবি যে বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচন ফ্রি ফেয়ার হতে হবে। কোনো রকম কারচুপির আশ্রয় নেওয়া যাবে না।’

এর মাধ্যমে সিইসি কেবল বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন নয়, অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষার কথাও বলেছেন। বিদেশি (বাইরের) থাবা বা হাত কীভাবে গুটিয়ে দেওয়া যাবে, সেই পরামর্শও দিয়েছেন। তাঁর মতে, একটি ফ্রি ও ফেয়ার নির্বাচন করেই সেটা সম্ভব।

নির্বাচন হলো প্রতিনিধি বাছাইয়ের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা। প্রথমেই যদি নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে প্রতিযোগীদের একাংশকে বাদ দেওয়া হয় কিংবা এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়, যাতে তাঁরা নির্বাচনে না যেতে পারেন, তা হলে সেই নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হবে কী করে? আর নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক না হলে সেটি ফ্রি ও ফেয়ার হতে পারে না।

নির্বাচন কমিশন বিএনপিকে বহুবার সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছে। বিএনপি তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। বিএনপির এই অবস্থান সঠিক নয়। জনসভা করার জন্য তারা যদি ডিএমপির দ্বিতীয় সারির কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসতে পারেন, নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে তাদের নালিশটি কেন কমিশনে জানাতে পারবে না? তাই বলে নির্বাচন কমিশন যেভাবে নয়াপল্টনে তালাবদ্ধ বিএনপির অফিসের ভেতরে একটি চেয়ারে চিঠি রেখে এসেছে, সেটা কেবল দৃষ্টিকটু নয়, হাস্যকরও। ওই চিঠিটি পাঠানো হয়েছিল বিএনপির মহাসচিবের কাছে, যিনি আগেই কারারুদ্ধ।

সে সময় নির্বাচন কমিশন সরকারকে বলতে পারেনি যে আমরা বিএনপিকে নির্বাচনের বিষয়ে সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। অতএব দলের নেতাদের ছেড়ে দিয়ে সংলাপের পরিবেশ তৈরি করুন। সিইসি তফসিল ঘোষণার সময় রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। দলগুলোকে একত্রে বসে সমঝোতায় আসার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি সরকারকে বলতে পারেননি বিরোধী দলের নেতাদের পাইকারি গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠালে নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট হয়।

কাজী হাবিবুল আউয়াল আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাকে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে কমান্ড করে, আমি তো ওয়াশিংটনে গিয়ে সেভাবে কমান্ড করতে পারব না।’ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকদের যত দোষ ও দুর্বলতাই থাকুক না কেন, তারা নির্বাচন নিয়ে এ রকম যুদ্ধাবস্থা তৈরি করবেন না, যাতে বিদেশিরা হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পান।

সিইসি একটি দেশকে লক্ষ্য করে বিদেশি হাত বা থাবার কথা বলেছেন। কিন্তু নিকট ও দূরের আরও অনেক দেশ যে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলিয়েছে, সে সম্পর্কে নিশ্চুপ থেকেছেন।

সিইসি ও তাঁর সভাসদ ২ বছর ১০ মাস ধরে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বাধাগুলো চোখে দেখলেও খোলাখুলি বলতে পারছেন না। এ কারণেই তাঁকে এখন অদৃশ্য বিদেশি হাত বা থাবার আতঙ্কে থাকতে হয়।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি