অনলাইন ডেস্ক।। গাজার স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের বড় ধরনের হামলায় হতবাক ইসরাইল ও তাদের মিত্ররা। দেশটির নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে হামাস যে আঘাত হেনেছে সেটি রীতিমত বিস্ময়ের ব্যাপার। হামাস যখন গাজার কাছাকাছি ইসরাইলের এলাকার ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে ইচ্ছামতো ঘোরাফেরা করছিল, ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী তখন কোথায় ছিল? অনেকেই এখন এই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। যেমন একজন ইসরাইলি অভিযোগ করেছেন, ‘ইসরাইলের সেনাবাহিনী দ্রুত জবাব দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।’
যেসব এলাকায় হামাস হামলা চালিয়েছে, সেখানকার বাসিন্দাদের সেনাবাহিনীর আসার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। যদিও এই সময় তারা নিরাপত্তার জন্য নিজেদের বেসামরিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ওপরেই নির্ভর করেছেন। কিন্তু এই হামলার ঘটনায় মনে হচ্ছে যে, ইসরাইলি সেনাবাহিনী এ ধরনের আকস্মিক, দ্রুতগতির ও বড়পরিসরের হামলায় হতচকিত হয়ে গিয়েছিল। তারা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, সেটি প্রতিরোধের জন্য তাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল না।
এ ধরনের আক্রমণ সফল করতে হলে হামাসের জন্যও এমন আকস্মিক হামলা চালানোই একমাত্র উপায় ছিল। হামাসের এই হামলার পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে ইসরাইলি গোয়েন্দারাও ব্যর্থ হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ইসরাইলকে বিভ্রান্ত করতে এই গোষ্ঠী বহুদিন ধরেই এমন আচরণ করে আসছিল যে, তারা পরিকল্পিত হামলা চালাতে অক্ষম বা তাদের ইচ্ছা নেই। গাজা থেকে তেলআবিবসহ ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার রকেট ছোড়া হয়েছে।
তারা সম্ভবত ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রাখা অনুশীলন করেছিল। যার কারণে তাদের অভিযানের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। সেই সঙ্গে তারা সম্ভবত ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করায় অভিযানের গোপনীয়তা বজায় রাখতে পেরেছে। এর পর হামাস গুরুত্ব দিয়েছে দ্রুতগতির আর বড়পরিসরে হামলা চালানোর ওপর। নিজেদের এসব কর্মকাণ্ড আড়াল করতে তারা ইসরাইলে হাজার হাজার রকেট উৎক্ষেপণ করেছে। ইসরাইলে কী ঘটছে তা নজরদারির জন্য সীমান্তবেষ্টনীতে যেসব পর্যবেক্ষণ সরঞ্জাম ব্যবহার করা হতো, সেগুলোর ওপরও ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে।
এর পর বিস্ফোরক এবং যানবাহন ব্যবহার করে নিরাপত্তাবেষ্টনীর অন্তত ৮০ জায়গা ভেঙে তারা ইসরাইলে প্রবেশ করে। এসব কাজে মোটরচালিত হ্যাং-গ্লাইডার অর্থাৎ অনেকটা প্যারাস্যুটের মতো দেখতে মানববাহী বাহন এবং মোটরবাইকও ব্যবহার করা হয়। এভাবে গাজা থেকে ৮০০ থেকে এক হাজার সশস্ত্র হামাস সদস্য একাধিক স্থানে আক্রমণ চালাতে শুরু করে এবং ছড়িয়ে পড়ে।
হামাসের এমন ঝাঁক বেঁধে প্রবেশের কৌশল ইসরাইলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে সফল হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে— অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও। এই বড়পরিসরের কার্যকলাপ ইসরাইলের নেতৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু একে তো শনিবার সকাল তার ওপর ধর্মীয় ছুটির দিন হওয়ায়, সেদিন পরিবেশ আগে থেকেই শান্ত ছিল। হামাসযোদ্ধাদের মধ্যে একটি অংশ বেসামরিক মানুষদের লক্ষ্য করে হামলা চালায় এবং অন্যরা সামরিক ফাঁড়িগুলো লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।
ইসরাইলি ট্যাংকগুলো দখল করে হামাস সদস্যদের ছবি পোস্ট করা আর সামরিক ঘাঁটিগুলো সহজে দখল করে নেওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে যে, এসব ঘাঁটির নিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা ঠুনকো ছিল। সেই সঙ্গে সীমান্তের সুড়ঙ্গগুলো দীর্ঘক্ষণ খোলা অবস্থায় ছিল, যাতে জিম্মিদের গাজায় নিয়ে যাওয়া যায় এবং শেষ পর্যন্ত ওই সুড়ঙ্গগুলো বন্ধ করার জন্য ট্যাংক ব্যবহার করা হয়। পুরো ঘটনায় ইসরাইলি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অগোছালো বলে মনে হয়েছে। ইসরাইলি নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বাহিনী সাম্প্রতিক মাসগুলোতে গাজার পরিবর্তে পশ্চিমতীরের দিকে বেশি নজর দিয়েছে। সেখানে একটা শূন্যতার তৈরি হয়েছে।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নানা নীতির কারণে ইসরাইলি সমাজে যে বিভক্তির সৃষ্টি হয়েছে, নিরাপত্তাব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করতে সম্ভবত সেটিও বিবেচনায় নিয়েছে হামাস। ইসরাইলের সামরিক ও গোয়েন্দাদের দীর্ঘ সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যের সেরা এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু তারা হয়তো তাদের প্রতিপক্ষের ক্ষমতাকে খাটো করে দেখেছিল।
হামাসের এই হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে, যখন কেউ ধারণাও করতে পারেনি যে যাত্রীবাহী বিমানগুলোকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। একে প্রায়ই ‘ফেইলিউর অফ ইমাজিনেশন’ বা ‘চিন্তার ব্যর্থতা’ বলেও অভিহিত করা হয়। এমন ‘চিন্তার ব্যর্থতা’ ইসরাইলের জন্য অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এতে করে তারা শত্রুপক্ষের এমন বড় ধরনের হামলা মোকাবিলার জন্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়বে। সূত্র: বিবিসি।