ইসলামী বার্তা ডেস্ক।। বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এরপরও যদি আমরা আমাদের কৃতকর্মে পরিবর্তন না আনি তাহলে আর কবে পরিবর্তন আনবো। এখনও আমরা নানা প্রকার অন্যায় কাজে জড়িয়ে আছি। প্রতিদিন জানা-অজানা কত পাপই না করছি। আমরা কি ভেবে নিয়েছি যে আমাদের পাপকর্মগুলো গোপনই থাকে যাবে? কৃতকর্মের ফল কি আমরা ভোগ করবো না?
আসলে আমরা গোপন আর প্রকাশ্যে যা-ই করি না কেন আল্লাহ তাআলা সবই দেখছেন। তার কাছে আমাদের প্রতিটি কর্মের হিসেব দিতে হবে। কেননা তিনি আমাদের প্রতিটি কর্ম লিখিত অবস্থায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা রেখেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
‘যা কিছু আকাশসমূহে রয়েছে এবং যা কিছু জমিনে আছে, সব আল্লাহরই। যদি তোমরা মনের কথা প্রকাশ কর কিংবা গোপন কর, আল্লাহ তোমাদের কাছ থেকে তার হিসাব নেবেন। অতপর যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা তিনি শাস্তি দেবেন। আল্লাহ সর্ব শক্তিমান।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৮৪)
ভালো কাজের কল্যাণ
এ আয়াতে কারিমা থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়, প্রত্যেককেই তার প্রতিটি কাজেরই হিসাব দিতে হবে, তা যতই গোপন হোক কিংবা প্রকাশ্য। আর এর জন্য পুরস্কার, শাস্তি বা ক্ষমা আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী পেতেই হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ আরও ইরশাদ করেন-
‘যে ভালো কাজ করে, সে নিজের উপকারের জন্যেই করে, আর যে অসৎ কাজ করে, তার প্রতিফলও সে-ই ভোগ করবে। আপনার পালনকর্তা বান্দাদের প্রতি মোটেই জুলুম করেন না।’ (সুরা হা-মিম সাজদা : আয়াত ৪৬)
বিচার ফয়সালার দিন আল্লাহ তাআলা মানুষের পাপ-পুণ্যের ফয়সালা করবেন এবং যার যার দুনিয়ার আমল-আখলাক কর্মফল অনুযায়ী নিখুঁত নিক্তিতে বিচার করবেন। যারা অন্যায়, অপরাধ, দুর্নীতি ও অসৎকর্মে নিজকে নিয়োজিত রাখবে এবং পাপাচারে লিপ্ত থাকবে, প্রতিফলস্বরূপ তিনি তাদের কঠিনতম শাস্তির ভয়াবহ কষ্টে নিপতিত রাখবেন।
আর যারা সৎকর্মের মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করবে এবং ইসলামের বিধি-বিধান অনুযায়ী ইহকালীন জীবন অতিবাহিত করবে, আল্লাহ তাদের সুখ-শান্তিময় বেহেশত প্রদান করবেন। শুধু তাই নয়, সেসব নেক আমলকারীকে সম্মানজনক পুরস্কার প্রদান করবেন।
সৎকর্মশীলদের জন্য রয়েছে জান্নাত
দুনিয়ায় সৎকর্মশীলদের জন্য জান্নাত দেয়া প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তাআলা অনেক সুসংবাদ ঘোষণা করেছেন-
– ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য আছে নেয়ামতে ভরা জান্নাত, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা লোকমান : আয়াত ৮-৯)
– ‘আজ প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে, আজ কারও প্রতি জুলুম করা হবে না। আল্লাহ হিসাব গ্রহণে তৎপর।’ (সুরা আল-মুমিন : আয়াত ১৭)
– ‘প্রত্যেকের মর্যাদা তার কর্মানুযায়ী, এটা এ জন্য যে আল্লাহ প্রত্যেকের কৃতকর্মের পূর্ণ প্রতিফল দেবেন এবং তাদের প্রতি অবিচার করা হবে না।’ (সুরা আল আহ্কাফ : আয়াত ১৯)
– ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।’ (সুরা আজ-জিলজাল : আয়াত ৭-৮)
এ জন্য মানবজাতিকে অপকর্ম ও অন্যায় প্রতিরোধের শিক্ষা দিয়েছেন প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি ঘোষণা করেছেন-
‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কাউকে অন্যায় কাজ করতে দেখে, তাহলে সে যেন তার হাত (শক্তি) দ্বারা তা প্রতিহত করে; যদি সে এতে অক্ষম হয়, তবে মুখ দ্বারা নিষেধ করবে, যদি সে এতেও অপারগ হয়, তবে সে অন্তর দ্বারা ঘৃণা পোষণ করবে অথ্যাৎ (নিরবে অন্যায় বন্ধের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে)।’ (মুসলিম)
আখেরাতে পাথেয় অর্জন করি
হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘দুনিয়া মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে (পিঠ দেখাচ্ছেঢ়) আর আখেরাত সামনে আসছে আর এদের প্রত্যেকটির সন্তানাদি রয়েছে। তবে তোমরা আখেরাতের সন্তান হও, দুনিয়ার সন্তান হইও না। কেননা এখন আমলের সময়, এখানে (দুনিয়ায়) কোনো হিসাব নেই, আর আগামীকল (আখেরাতে) হিসাব-নিকাশ হবে। সেখানে আমল করার কোনো সুযোগ নেই।’ (বুখারি)
আমরা যদি ভাবি যে, এই দুনিয়া হচ্ছে আনন্দ-ফূর্তির জায়গা, যখন যা ইচ্ছা করবো, আমাকে কে ধরবে? সে ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, এ দুনিয়া এক পরীক্ষা কেন্দ্র। আমরা সবাই পরীক্ষা দিচ্ছি, যে ভালো পরীক্ষা দেবে, সে ভালো ফলাফল লাভ করবে; এটাই স্বাভাবিক।
সে দিন কেউ বলতে পারবে না যে, হায়! আমি যদি আবারও দুনিয়াতে যেতে পারতাম তাহলে ভালো কাজ করে আসতাম। আমরা যা কিছুই করি না কেন আল্লাহ তা জানেন ও দেখেন। আল্লাহ তাআলার সামনে আমাদের সবাইকে উপস্থিত হতেই হবে। প্রত্যেককে প্রতিটি কর্মের হিসাব দিতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘আর তারা সবাই আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে। তখন দুর্বল লোকেরা অহংকারীদেরকে বলবে, নিশ্চয় আমরা তোমাদেরই অনুসারী ছিলাম। অতএব, তোমরা আমদের আজাবের কিছুটাও কি দূর করতে পার? তারা বলবে, আল্লাহ যদি আমাদের হেদায়েত দিতেন, তাহলে আমরা অবশ্যই তোমাদের হেদায়েত দিতাম। আমাদের জন্য এখন বিলাপ করা বা ধৈর্য ধারণ করা উভয়ই সমান। রক্ষা পাওয়ার কোনো পথই আমাদের নেই।’ (সুরা ইবরাহিম, আয়াত: ২১)
আমাদের যেদিন আল্লাহ তাআলার সামনে উপস্থিত করা হবে সেদিন কেউ কারও বোঝা বহন করার সুযোগ পাবে না। যার যার হিসাব তাকেই দিতে হবে এবং আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দিতে পারেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত সাফওয়ান ইবনে মুহরাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, এক ব্যক্তি হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করলো, কেয়ামতের দিন আল্লাহ ও ঈমানদার বান্দার মধ্যকার গোপন আলোচনা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আপনি কীভাবে বলতে শুনেছেন? তিনি বললেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে এক ব্যক্তি তার রবের কাছাকাছি হবে, এমন কি রব তার কুদরতি হাত ওই বান্দার ওপর রেখে দু’বার বলবেন, তুমি (দুনিয়ায়) অমুক অমুক কাজ করেছিলে। সে বলবে, জি হ্যাঁ। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করবেন, তুমি কি এমন কাজ করেছিলে? সে বলবে, জি হ্যাঁ। এভাবে তার কাছ থেকে এর স্বীকৃতি আদায় করা হবে, তারপর বলবেন, আমি দুনিয়ায় তোমার গোনাহ গোপন করে রেখেছি। আজ আমি তা মাফ করে দিচ্ছি।’ (বুখারি)
পরকালের বিচার দিবসে প্রত্যেককেই তার প্রতিটি কর্মের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে এবং প্রতিটি কাজের কর্মফলই মানুষ ভোগ করবে। কর্মফল অনুযায়ী বিচার ফয়সালা চূড়ান্ত হবে।
সুতরাং আমাদের এমনভাবে জীবন অতিবাহিত করতে হবে যেন আমার দ্বারা কোনোরূপ অন্যায় কাজ না হয়। আমার হাত ও মুখ দ্বারা কারও ক্ষতি হোক এমন কোনো কাজ যেন আমি না করি। সেই সঙ্গে যে কারও সম্পর্কে যে কোনো ধরণের মিথ্যা অভিযোগ ছড়িয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা থেকেও নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কেননা আমার কর্মের জন্য আমাকেই আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।