২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশ থেকে আবির্ভূত হয়ে দুনিয়াজুড়ে মহামারি সৃষ্টি করে বিরল এক আতঙ্ক করোনা ভাইরাস। করোনার প্রকোপ থেকে জীবন রক্ষা করতে পারেনি ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাও। দুনিয়াব্যাপী এক ভয়াবহ নিস্তব্ধতা ছিল গত বছরের শেষ অব্দিও। যে সময়টায় বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার মানুষ করোনার থাবায় প্রাণ হারিয়েছে সে সময়টায় চীনের করোনা মৃত্যুর সংখ্যা দেখানো হয়েছে মাত্র ৫ হাজারের মতো। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সংক্রমণের সব রেকর্ড ভেঙ্গে গেছে দেশটিতে। তার প্রভাব ইতোমধ্যে প্রতিবেশি দেশ ভারতসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে টের পাওয়া যাচ্ছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে করোনার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছিল শি জিনপিং সরকার। কিন্তু এত কঠোর নিয়মের ফাঁদে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে জনজীবন। দেশটির অর্থনীতিতে নামতে থাকে ধস, সেইসঙ্গে বাড়তে থাকে বেকারত্ব। পরিস্থিতি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়ায় পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামে চীনা জনগণ। অবশেষে জনবিক্ষোভের মুখে জিরো-টলারেন্স নীতি থেকে সরে আসতে হয় চীন সরকারকে।
নীতি থেকে সরে আসার পরপরই সবথেকে ভয়ানক চিত্র শুরু হয় ১৪০ কোটি বাসিন্দার দেশ চীনে। তেজি ঘোড়ার বেগে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। বিশ্লেষণ আর গবেষকদের ভবিষ্যদ্বাণী বলছে, এই অবস্থা চলতে থাকলে প্রতিদিন দেশটিতে ১০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হবে এবং মৃত্যু ঘটতে পারে ৫ হাজারের। এমনকি আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যে দেখা দেশব্যাপী এক-তৃতীয়াংশ জনগণই আক্রান্ত হতে পারে এই ভাইরাসে। লন্ডন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা এয়ারফিনিটি লিমিটেডের মতে, এই বর্তমান করোনার ঢেউ অব্যাহত থাকলে জানুয়ারিতেই দৈনিক শনাক্তের হার ৩০ লাখ ৭০ হাজার পর্যন্ত বাড়তে পারে। মূলত দেশটির সাম্প্রতিক করোনা পরিস্থিতি এবং সংক্রমণের হারের ওপর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমেই এমনটা দাবি করা হয়েছে। জানুয়ারির পর সম্ভবত সংক্রমণের আরও একটি ঢেউ আসতে পারে যার ফলে মার্চ মাসে দৈনিক সর্বোচ্চ ৪০ লাখ ২০ হাজার জন আক্রান্ত হবে।
বর্তমানে চীনজুড়ে দ্রুত গতিতে ছড়াচ্ছে করোনা। রয়টার্স জানিয়েছে, ইতোমধ্যে সাংহাইয়ের একটি হাসপাতাল তার কর্মীদেরকে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে ভয়াবহ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছে। তাদের ধারণা আগামী সপ্তাহের শেষ নাগাদ শহরটির ২ কোটি ৫০ লাখ লোকের অর্ধেকই সংক্রামিত হবে। বুধবার পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, উপসর্গসহ এখন পর্যন্ত ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৩০৬জন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন তার দুর্বল বয়স্ক জনসংখ্যার মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম সম্পূর্ণ টিকা দেওয়ার হারের কারণে আগামী বছর দশ লাখের বেশি কোভিড মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী চীনের টিকা দেওয়ার হার ৯০ শতাংশের বেশি কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য যারা বুস্টার শট পেয়েছে তাদের হার ৫৭.৯ শতাংশ এবং ৮০ বছর বা তার বেশি বয়সের লোকেদের ক্ষেত্রে ৪২.৩ শতাংশ।
বিশ্বে করোনার প্রভাব কেমন হবে?
চীনের এমন নজিরবিহীন করোনা সংক্রমণের ফলে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে। তবে কী আবারও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যেতে পারে এই মহামরি? প্রশ্নটা মনে উঁকি দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। যদি মহামারি নাও ছড়ায় তবে বিশ্ব অর্থনীতে মারাত্মক প্রভাব দেখা যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
ডিসেম্বরের মাসিক প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, মূল্য বৃদ্ধি এবং সরবরাহের সীমাবদ্ধতার ঝুঁকি ছাড়াও জাপান চীনের বর্তমান কোভিড পরিস্থিতির প্রতি গভীর মনোযোগ দেবে। কেননা বর্তমান সময়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি জাপানকে মন্থর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি এবং উচ্চ আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে লড়াই করতে দেখা গেছে যা দেশটির রপ্তানি এবং উত্পাদন কার্যকলাপকে প্রভাবিত করছে। মন্ত্রিপরিষদ অফিসের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘যদি চীনের সংক্রমণ পরিস্থিতি সাপ্লাই চেইন বা বাণিজ্যের ওপর প্রভাব ফেলে, তবে এটি জাপানের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে যেমনটি আমরা এই বছরের শুরুতে দেখেছি।’
এদিকে, টোকিও এক বছরে প্রথমবারের মতো ব্যবসায়িক অনুভূতির বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি আপগ্রেড করেছে বলে পুনরুদ্ধারের আশা জাগাচ্ছে। সরকার আশা করছে, ব্যাংক অব জাপান অর্থনীতি, মূল্য এবং আর্থিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে স্থিরভাবে তার দুই শতাংশ মূল্য লক্ষ্য অর্জন করবে।
জাপানের পাশাপাশি প্রতিবেশি ভারতেও করোনা নিয়ে বাড়তি উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ভারতের গুজরাট ও ওডিশা রাজ্যে ভাইরাসটির ওমিক্রন ধরনের বিএফ.৭ উপধরনে আক্রান্ত চারজন রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত বুধবার এ নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থরা। বৃহস্পতিবার বিকালে করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা গেছে, অক্টোবর-নভেম্বরে অমিক্রনের বিএফ.১২ উপধরনও শনাক্ত হয়েছিল ভারতে। বাসায় আইসোলেশনে রেখে যাঁদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা পুরোপুরি সেরে উঠেছেন। জুলাইতে প্রথম রোগী শনাক্ত হয়েছিল বলেও সূত্রগুলো জানিয়েছে। এতদিন দেশটিতে কোভিড বিধিনিষেধ পালনে বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বৃহস্পতিবার থেকে সব বিমানবন্দরে দৈবচয়নের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক যাত্রীদের নমুনা পরীক্ষার পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
বাংলাদেশের একেবারেই নিকটতম রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারও করোনা মোকাবিলায় আপাতত ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ কৌশলেই এগোতে চাইছে বলে জানিয়েছে রাজ্যটির স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পশ্চিমবঙ্গে দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দশের নীচে থাকলেও চীনে যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে তাতে যেকোনো সময় ভারত তথা বাংলায় করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়তে পারে বলে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছে। মূলত বড়দিন ও ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে কয়েক দিন পরেই ভিড় বাড়বে রাস্তা-রেস্তরাঁয়। এই পরিস্থিতিতে কোভিড নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
বিশ্ব অর্থনীতি
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের জটিল ভ্যাকসিন কভারেজ, ভঙ্গুর স্বাস্থ্য কাঠামো এবং কোভিড-১৯ কেস বাড়তে শুরু করার সাথে সাথে সংক্রমণের প্রকৃত পরিমাণ সম্পর্কে স্পষ্টতার অভাবের কারণে ‘জিরো-কোভিড’ খাদ করার নক-অন প্রভাবগুলি অত্যন্ত অনিশ্চিত। বিশ্বব্যাংক মঙ্গলবার তার নড়বড়ে সম্পত্তি খাতসহ অন্যান্য কারণের পাশাপাশি কঠোর কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আকস্মিক শিথিলকরণের প্রভাবকে তালিকাভুক্ত করে এই বছর এবং পরবর্তী জন্য চীনের প্রবৃদ্ধির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কমিয়েছে।
ব্যাংক অব জাপানের গভর্নর হারুহিকো কুরোদা চীনে ভাইরাসের পুনরুত্থানকে বিশ্ব অর্থনীতিতে নিম্নমুখী চাপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যখন তাইওয়ান চীনে কোভিড-১৯ এর বিস্তারকে তার অর্থনীতির মুখোমুখি একটি বড় অনিশ্চয়তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
তবুও ঐকমত্যের দৃষ্টিভঙ্গি রয়ে গেছে। চীন যদি এই মাসে মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি জ্যানেট ইয়েলেন তার কভিড-১৯ অবস্থান পরিবর্তনের ‘খুব জটিল সমস্যা’ বলে অভিহিত করে, তবে এটি তার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি এবং বৈশ্বিক উভয়কেই বাড়িয়ে তুলবে। এর ফলে গ্রুপ অব সেভেন (জি-৭) দেশগুলির নীতিনির্ধারকদের এই বিশ্বাসকে আরও মজবুত হবে যে, তারা সুদের হার বাড়ালে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং এর ফলে যেকোনো মন্দা তুলনামূলকভাবে অগভীর এবং স্বল্পস্থায়ী হবে।
কন্টিনিউম ইকোনমিক্সের গবেষণা পরিচালক মাইক গ্যালাঘের বলেছেন, ‘আপনি যদি কোভিড তরঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ছয় মাস অপেক্ষা করেন ... আমরা এমন একটি বিন্দুতে পৌঁছে যাব যেখানে চীন যেমন অন্য সবাই কোভিডের সাথে বসবাস করতে পারে। বড় কৌশলগত খেলাটি আবার খোলার দিকে। এটি খুব আড়ষ্ট হতে চলেছে।’
যাই হোক না কেন, চীনের পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ
ভারতের বন্ধন ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ সিদ্ধার্থ সান্যাল বলেন, ‘যদি চীনের গতি কমে যায়, যদি চীন আগামী দুই, তিন-চার মাসের মধ্যে বন্ধ করে দেয়, তার মানে বিশ্ব অর্থনীতিতে পুনরুদ্ধারের গতি অদূর সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং দোলানো অর্থনীতিতে বা এমনকি ছোটগুলিকে পঙ্গু করে দেওয়ার ক্ষেত্রে তার আধিপত্য অস্বীকার করার কিছু নেই। প্রকৃতপক্ষে, বৈশ্বিক অর্থনীতি এখনও জঙ্গলের বাইরে যেতে পারেনি এবং ভারত এখনও তার উত্তেজনা থেকে অনেক দূরে রয়েছে এই প্রেক্ষাপটে এর প্রভাবগুলি এখন আরও গভীর হতে পারে। অর্থনীতিবিদদের মতে জিরো টলারেন্স এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বিঘ্নিত পদক্ষেপ ইতিমধ্যে দেশটিকে মন্থরতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এটি শিথিল করার পরপরই পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধি মন্দা ছাড়াও, চীনের বেকারত্বের পরিস্থিতি নাজুক রয়েছে এবং এটির একটি নড়বড়ে সম্পত্তির বাজার রয়েছে যা ব্যাঙ্কের ঋণ বইগুলিকে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
প্রকাশকঃ খাইরুল ইসলাম আল আমিন, প্রধান সম্পাদকঃ আবুল খায়ের, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ৯৫ পাটবাজার (পুকুরপাড়), ঈশ্বরগঞ্জ পৌরসভা, ঈশ্বরগঞ্জ, ময়মনসিংহ , ওয়েবসাইট-www.durnitibarta.com, মোবাইলঃ 01710-492468, ইমেইল- [email protected]