অনলাইন ডেস্ক:
বছরের এই একটি দিনের জন্য লন্ডনের সব প্রবাসী বাঙালিরা অপেক্ষা করতে থাকে অনেক আগ্রহ ও আনন্দের সাথে। আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কোন দিনটির কথা বলছি। হুম, ঠিকই ধরেছেন- পহেলা বৈশাখের দিনটি।
আমরা সবাই জানি, বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব ‘বাংলা নববর্ষ’ আর বাংলা নববর্ষের মূল আকর্ষণ হচ্ছে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। এখানেও অনেক আনন্দ ও উদ্দীপনার সাথে বাংলা নববর্ষ পালন করা হয়। তবে এখানে পালন করার নিয়মটি একটু অন্য রকমের।
সাধারণত আমরা বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিলে বাংলা নববর্ষ পালন করি, কিন্তু লন্ডনে এটি পালন করা হয় গ্রীষ্মের শুরুতে। তবে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয় রোজা শুরু হওয়ার আগেই যেন পালন করা হয়।
গত বছর টাওয়ার হামলেট আয়োজন করেছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং সেই সাথে আরও ছিল শিশুদের জন্য রচনা প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানগুলো সকাল থেকেই শুরু হয়েছিল, তবে কাজের কারণে মিস করেছিলাম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটা।
এখানকার নববর্ষের মেলাতে যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি ইউরোপের ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন থেকেও বাঙালিরা আসেন।
ইংল্যান্ডে আসার পর মনে হচ্ছিল, এখানে যদি সবাই পহেলা বৈশাখটি পালন করতে পারতো! মঙ্গল শোভাযাত্রা ও মেলার জন্য খুব মন টানছিলো। কারণ বাংলাদেশে থাকতে কখনও পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে না যেয়ে থাকতে পারতাম না।
সকাল সাড়ে ৬টায় চলে যেতাম চারুকলার সামনে। এরপর সারাদিন আনন্দের সাথে দিন পার করতাম বন্ধু-বান্ধবের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। কিন্তু এখানকার জীবনযাপন অন্যরকম হওয়াতে, মানে এখানে সবাই তো খুব ব্যস্ত থাকে কাজ আর পড়াশোনা নিয়ে, তাই একটু দ্বন্দ্বে ছিলাম- এখানকার মানুষ বাংলা নববর্ষ পালন করে কিনা।
ঠিক তখনই আমার ছোট বোন বললো, চিন্তা করিস না এইখানেও সব বাঙালিরা খুব আনন্দ ও উদ্দীপনার সাথেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে।
কথাটি শোনার সাথে সাথে আমি আর দেরি করিনি নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য, কারণ তখন আমার হাতে ছিলোই আর মাত্র দুই দিন। সাধারণত বাংলাদেশে থাকতে আমরা এক মাস আগের থেকে শপিং করা শুরু করি এই দিনটির জন্য। কিন্তু এখানে জীবনযাত্রা অন্যরকম হওয়াতে অনেক দুশ্চিন্তা কাজ করছিল।
তারমধ্যে প্রথম চিন্তা ছিল, কীভাবে কর্মক্ষেত্র থেকে ছুটি পাবো? আবার একদিক দিয়ে বেঁচে গেলাম, মেলাটি রোববারে হওয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নিয়ে চিন্তা করতে হলো না।
যেহেতু সপ্তাহে রোববার ছুটি থাকে, সেহেতু ওইভাবে চিন্তা করে মেলাটি সবসময় এইখানে আয়োজন করা হয়। কিন্তু রোববারে কাজ থাকায় সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম, যার কারণে অনেক চেষ্টা করেছিলাম ছুটি নেওয়ার। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ছুটিটি পাইনি ওইদিন।
আমার যতদূর মনে আছে, সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত কাজ করে কোনো রকমে তৈরি হয়েই ছুটে গিয়েছিলাম মেলাতে। সাধারণত বাংলা নববর্ষের মেলাটি সবসময়ই আয়োজন করা হয় পূর্ব লন্ডনেই।
খুব বেশি কষ্ট হয়নি জায়গাটি বের করতে, মানে মেলাটি যে জায়গায় হচ্ছিলো। কারণ বাস থেকেই আমি দেখেছি, আশপাশে প্রায় সব মানুষই বাঙালি এবং বেশিরভাগ মানুষ দেশিয় পোশাক পড়ে মেলাতে যাচ্ছে।
তবে সবচেয়ে যে জিনিসটি আমাকে আকর্ষণ করেছে তা হলো, বেশিরভাগ পুরুষরা পাঞ্জাবি ও নারীরা লাল পাড়ের সাদা রংয়ের শাড়ীর সাথে মিলিয়ে দেশিয় গহনা পরে এসেছিল।
মেলাতে ঢোকার সাথে সাথে দেখতে পেলাম, বিশাল মাঠ জুড়ে পুরো মেলাটি আয়োজন করা হয়েছিল। এ যেন অন্য রকম অনুভূতি! সবচেয়ে অবাক লেগেছিল, আমার এক বান্ধবীর সাথে দেখা হয়েছিল দীর্ঘ ১০ বছর পর।
বোঝাতে পারবো না ওই মুহূর্তে কী পরিমাণ আনন্দে ছিলাম! তাছাড়া মেলাতে যাওয়ার পর একটিবারের জন্যও অনুভব করিনি যে আমি অন্য দেশে আছি। খালি মনে হচ্ছিল আমি এখনও বাংলাদেশে আছি।
একটু মন খারাপ ছিল প্রথমে। কারণ আমি মনে হয় কনসার্টটা মিস করবো। কিন্তু সেটা শুরুর প্রায় পরপরই পৌঁছে গিয়েছিলাম। এরপর পুরো মেলাটি ঘুরে ঘুরে দেখলাম এবং উপভোগ করলাম।
চারিদিকে শুধু বাঙালি আর বাঙালি! এ যেন আরেক বাংলাদেশ। মেলাতে সবচেয়ে বেশি আর্কষণীয় ছিল বিভিন্ন রকমের বাংলা খাবার, যেমন- সাদা ভাত, ইলিশ মাছ, বিরিয়ানি, তেহারি, চটপটি, ফুসকা, সমুচা ও সিঙ্গারা ইত্যাদি।
এছাড়াও আয়োজনে ছিল বিভিন্ন রকমের পিঠা ও মিষ্টি। তবে বেশিরভাগ খাবারের মূল্য ১ পাউন্ড থেকে শুরু করে ২০ পাউন্ড পর্যন্ত ছিল।
এছাড়াও ছিল দেশিয় পোশাকের স্টল, যেমন- সালোয়ার কামিজ থেকে শুরু করে জামদানি, টাঙ্গাইল ও সুতি টাইপের বিভিন্ন ধরনের ডিজাইনের শাড়ী এবং মূল্য ১০ পাউন্ড থেকে শুরু করে ৫০০ পাউন্ড পর্যন্ত ছিল। এমনকি আয়োজকরা বাচ্চাদের জন্য আয়োজন করেছিল বিভিন্ন ধরনের খেলনা বা রাইডস।
এছাড়াও কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছিল। মনে হচ্ছিলো, ওই মুহূর্তে আমি শাহবাগ চত্বর বা চারুকলায় আছি। একের পর এক বাংলা গানে মুখরিত হয়ে উঠছিল পুরো মাঠ। টানা ৬ দিন কাজ করার পরও এক ফোঁটা ক্লান্তি অনুভব করিনি ওইদিন, বরং আনন্দের সাথেই দিনটি কাটালাম।
যেহেতু বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় জায়গা পেয়েছে, সেহেতু এবারেরটি হয়তো অন্যরকম হবে।
ধন্যবাদ জানাচ্ছি এখানকার বাঙালি কমিউনিটিকে, যাদের প্রচেষ্টায় প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা ও মেলাটি আয়োজিত হয় এবং এই আয়োজনের মাধ্যমেই আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি ফুটে উঠে। আরও ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই কারণে যে, তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি এখনও বেঁচে আছে।